অষ্টম অধ্যায়
চরিতমালা
বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও প্রসারে থের থেরীর অবদান অপরিসীম। ভিক্ষু-ভিক্ষুণী হিসেবে যাঁরা দশ বছর জীবন অতিবাহিত করেছেন তাঁদেরকে থের ও থেরী বলা হয়। থেরকে স্থবিরও বলা হয়। স্থবির অর্থ সাধনায় স্থিত থাকা । থের, থেরী, স্থবির প্রভৃতি উপাধি বিশেষ। প্রবীণ, জ্ঞানী ভিক্ষু-ভিক্ষুণীগণ এসব উপাধি প্রাপ্ত হন। মহৎ কর্মগুণে তাঁরা বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তাঁরা কীভাবে মহৎ জীবন গঠন করেছিলেন তার বর্ণনা বৌদ্ধ সাহিত্যে পাওয়া যায়। তাঁদের জীবনী এবং ভাষিত গাথাগুলো আমাদের নৈতিক জীবন গঠনে উদ্বুদ্ধ করে। বুদ্ধের সময় ও বুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অনেক বৌদ্ধ মনীষী বৌদ্ধধর্ম, দর্শন ও সাহিত্যের বিকাশে বিশেষ অবদান রেখেছেন। তাঁদের জীবন দর্শন থেকেও অনেক কিছু শেখার আছে। জীবনকে সুন্দর করার জন্য সেসব থের-থেরী ও বরেণ্য মনীষীদের জীবন চরিত পাঠ করা উচিত। এ অধ্যায়ে আমরা স্থবির অনুরুদ্ধ, স্থবির অঙ্গুলিমাল, মহিয়ষী নারী মল্লিকা দেবী এবং বিখ্যাত অটঠকথা রচয়িতা বুদ্ধঘোষ সম্পর্কে পড়ব এ অধ্যায় শেষে আমরা-
* থের থেরী ও বিশিষ্ট বৌদ্ধ মনীষীদের জীবনী ব্যাখ্যা করতে পারব।
* থের থেরী ও বিশিষ্ট বৌদ্ধ মনীষীদের অবদান মূল্যায়ন করতে পারব।
পাঠ : ১
স্থবির অনুরুদ্ধ
স্থবির অনুরুদ্ধ স্মরণীয় এক বৃদ্ধ শিষ্যের নাম। তিনি একান্ত প্রচেষ্টা ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে এই গৌরব অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এর জন্য তাঁকে জন্ম-জন্মান্তরে সাধনা করতে হয়েছে। তিনি এক এক জন্মে এক এক নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর এ প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল পদুমুত্তর বুদ্ধের সময়ে । গৌতম বুদ্ধের পূর্ববর্তী বুদ্ধদের একজন ছিলেন পদুমুত্তর বুদ্ধ।
পদুমুত্তর বুদ্ধের সময়ে তিনি এক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ধর্মশ্রবণের জন্য একদিন তিনি বিহারে গিয়েছিলেন। তখন পদুমুত্তর বুদ্ধ দিব্যচক্ষুসম্পন্ন এক ভিক্ষুকে ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠাসনে নিয়োগ দান করেন। তিনিও সেই পদ প্রার্থী হয়ে বুদ্ধ প্রমুখ লক্ষ ভিক্ষুকে এক সপ্তাহ ধরে দান করেন। পদুমুত্তর বুদ্ধ তাঁকে আশীর্বাদ করলেন যেন গৌতম বুদ্ধের সময় তাঁর মনোবাসনা পূর্ণ হয়। পরে কশ্যপ বুদ্ধের সময় বারানসিতে এক ধনী পরিবারে তিনি জন্ম নেন। কশ্যপ বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ কালে তিনি কনকচৈত্যের চারদিকে ঘৃতপূর্ণ তাম্রপাত্রে প্রদীপ পূজা করেছিলেন। সে ঘৃতভান্ড মাথায় ধারণ করে সারা রাত চৈত্য প্রদক্ষিণ করেন। মৃত্যুর পর তিনি দেবলোকে উৎপন্ন হন। সেখান থেকে আয়ুশেষে পুনরায় বারানসিতে এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেন। তখন তাঁর নাম রাখা হয়েছিল চরিতমালা
অনুভার। তিনি সুষম নামক এক শ্রেষ্ঠীর বাড়িতে কাজ করতেন। একদিন উপরিঠ নামক এক পচ্চেকবুদ্ধ ভিক্ষা করেছিলেন। পচ্চেকবুদ্ধকে দেখে অনুভার নিজের খাদ্যের অংশ তাঁকে দান করে দেন। প্রগাঢ় শ্রদ্ধাবশত গৃহপত্নীর অংশও দান করে দেন। নিজেদের জন্য বিন্দু মাত্র অবশিষ্ট না রেখে দান করে দেয়া এক বিরল ঘটনা। এ ঘটনা দেখে দেবতারাও বিস্মিত হলেন ।
শ্রেষ্ঠী অনুভারের উত্তম দানের কথা শুনে তিনি অন্নভারকে একহাজার মুদ্রা পুরস্কৃত করলেন। মনে মনে তিনিও এর পুণ্যাংশ কামনা করেন। সেদিন থেকে শ্রেষ্ঠী অনুভারকে গৃহকর্ম করতে দিতেন না। তিনি অনুভারকে বাণিজ্যকর্ম দ্বারা জীবনযাপন করতে বলেন। একদিন রাজদর্শনে যাবার সময় শ্রেষ্ঠী অনুভারকে সঙ্গে নিলেন । রাজা শ্রেষ্ঠীর প্রতি করুণা প্রদর্শন করলেন। শ্রেষ্ঠী রাজাকে বললেন, মহারাজ অনুভার অত্যন্ত পুণ্যবান। আমি একহাজার মুদ্রা দিয়ে তাঁর কাছ থেকে পুণ্যাংশ গ্রহণ করেছি।
রাজাও সন্তুষ্ট হয়ে অনুভারকে একহাজার মুদ্রা প্রদান করলেন। তাঁকে পছন্দমত একটি স্থান নির্বাচন করে বসতি স্থাপন করে বাণিজ্যকর্ম দ্বারা জীবনযাপন করতে উপদেশ দিলেন।
অন্নভার যেদিন পচ্চেক বুদ্ধকে পিণ্ডদান করেছিলেন সেদিন থেকে পুণ্যফল ভোগ করতে থাকেন। রাজার নির্দেশে তিনি বাড়ি তৈরির জন্য নির্দিষ্ট স্থান পরিষ্কার করছিলেন। উঁচু নিচু স্থান সমতল করার সময় নিধিকুম্ভ উঠতে লাগল। সে ধনরত্নের কলসে সমস্ত স্থান পূর্ণ হলো । তিনি তা দেখে রাজাকে সংবাদ দিলেন। রাজা সে ধনস্তূপ দেখে সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন, এরূপ ধন আমার রাজ্যে অন্য কারও আছে কি? সকলে একবাক্যে উত্তর দিল না মহারাজ, কারও নেই। সেদিন থেকে তাঁর নাম রাখা হয় ধনশ্রেষ্ঠী ।
এভাবে তিনি বহু জন্ম কুশলকর্ম সম্পাদন করেন। অতঃপর গৌতম বুদ্ধের সময় কপিলাবস্তু নগরে শাক্যবংশে জন্মগ্রহণ করেন। এই জন্মেই তার নাম রাখা হয় অনুরুদ্ধ। পিতার নাম ছিল অমিতোদন। অমিতোদন ছিলেন রাজা শুদ্ধোদনের ভাই । অনুরুদ্ধের চেহারা ছিল অত্যন্ত সুন্দর ও কোমল। এ মহাপুণ্যবান ব্যক্তি পরম সুখেই দিন যাপন করেছিলেন। পিতা তার জন্য তিন ঋতুর উপযোগী তিনটি প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। তিনি দেবকুমারের ন্যায় দিব্যসুখ ভোগ করতে থাকেন। একদিন তিনি রাজা শুদ্ধোদন কর্তৃক উৎসাহিত হয়ে ভদ্দিয়কুমার প্রভৃতির সঙ্গে অনুপ্রিয় আম্রবনে গমন করে বর্ষাকালেই প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। সেই বর্ষার মধ্যেই তিনি দিব্যজ্ঞান লাভ করেন। তারপর ধর্মসেনাপতি সারিপুত্রের নিকট কর্মস্থান ভাবনা গ্রহণ করে প্রাচীনবংশ নামক বনে গমন করেন । একদা তিনি সপ্তমহাপুরুষ বিতর্ক সম্বন্ধে চিন্তা করছিলেন। কিন্তু তিনি অষ্টম বিতর্ক কিছুতেই করতে পারছিলেন না। বুদ্ধ তাঁকে তা জ্ঞাপন করে আর্যবংশ সূত্র দেশনা করেন। অনুরুদ্ধ সেই দেশনা অনুসারে ভাবনা করে অর্হত্ব ফল লাভপূর্বক অনেক প্রীতিগাথা ভাষণ করেন। নিচে তাঁর ভাষিত গাথার সারমর্ম দেয়া হলো:
ফর্মা ১১, বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা-অষ্টম শ্রেণি
৮২
বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা
'প্রতিদিন আমি' নৃত্য-গীত দ্বারা পূজিত হতাম। সকালে নৃত্যতালে আমাকে জাগ্রত করা হতো। এই ভোগ-বিলাসিতা দ্বারা আমি শুদ্ধিলাভ করতে পারিনি। এসব ভোগ-বিলাস ত্যাগ করে আমি রুদ্ধশাসনে প্রব্রজিত হই। রূপ-রস-শব্দ-গন্ধ-স্পর্শ ত্যাগ করে ধ্যান করতে শুরু করি। এভাবে আমি আসক্তি মুক্ত হই যিনি যখালব্ধ বস্তুতে সন্তুষ্ট থাকেন, বিক্ষিপ্ত চিত্ত সংযত করেন, আলস্য ত্যাগ করে উদ্যমশীল হন, তাঁর বোধিপক্ষীয় কুশলধর্মগুলো উৎপন্ন হয়। যখন আমার চিত্তে বিতর্ক উদিত হয়েছিল তখন তথাগত বুদ্ধ আমাকে ধর্ম দেশনা করেন। আমি তাঁর ধর্ম দেশনা অনুসরণ করে ত্রিবিধ বিদ্যা লাভ করে বুদ্ধশাসনে কৃতকার্য হই ।
পাঠ : ২
স্থবির অঙ্গুলিমাল
কোশলরাজ প্রসেনজিতের রাজপুরোহিত ছিলেন ভার্গব নামে এক ব্রাহ্মণ। সেই ব্রাহ্মণের ঘরে অঙ্গুলিমালের জন্ম। ব্রাহ্মণ পুত্রসন্তান লাভ করে অত্যন্ত আনন্দিত হন। অঙ্গুলিমাল পূর্ব বুদ্ধগণের আশীর্বাদ প্রাপ্ত হয়ে গৌতমবুদ্ধের সময় এ রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মক্ষণে সমস্ত নগরের অস্ত্রশস্ত্রসমূহ উজ্জ্বল বর্ণ ধারণ করল। শয়ন কক্ষে রাজার মঙ্গলায়ুধ হতে জ্যোতি বের হলো। এতে রাজা ভীত সন্ত্রস্ত হন। সারারাত রাজার ঘুম হলো না। পুরোহিত ঐ লক্ষণ দেখে চিন্তিত হলেন। তিনি শাস্ত্র পর্যালোচনা করে তাঁর ছেলের জন্ম নক্ষত্র জ্ঞাত হলেন। অতঃপর তিনি সকালে রাজাকে দর্শন করতে গেলেন । আলাপচারিতায় জানতে পারলেন রাজা সারারাত ঘুমাতে পারেননি। রাজা পুরোহিতের নিকট অস্ত্রাগারে আগুনের ফুলকি ওঠার কারণ জানতে চাইলেন। পুরোহিত বললেন, 'মহারাজ! ভয় করবেন না। আমার এক পুত্র সন্তান জন্ম নিয়েছে। চোর নক্ষত্রে তার জন্ম। তাই এরূপ অদ্ভুত কান্ড হয়েছে।
রাজা বললেন, ভবিষ্যতে সে কেমন হবে? পুরোহিত বললেন, মহারাজ, চোর নক্ষত্রে জন্ম হওয়ায় সে ভবিষ্যতে দস্যু হবে। রাজা আবার জিজ্ঞেস করলেন, সে একাকী দস্যু হবে নাকি দলবদ্ধ হয়ে দস্যুপনা করবে? পুরোহিত বললেন মহারাজ, একাই করবে। তখন রাজা জিজ্ঞেস করলেন, তাকে হত্যা করব কি? এ প্রশ্নে পুরোহিত নীরব রইলেন। রাজা পুনরায় বললেন, 'যদি একাকী দস্যুতা করে সে কী আর করতে পারবে? তাকে দমন করার শক্তি কোশল রাজার আছে। তাকে আপনি লালন করতে পারেন। কোশল রাজার অনুমতি পেয়ে পুরোহিত তার পূত্রকে পালন করতে লাগলেন। জনুক্ষণে রাজার মনে দুঃখ দিয়েছিল বলে এ শিশুর নাম রাখা হয় "হিংসক'। কিন্তু পরে তার আচার-আচরণে মুগ্ধ হয়ে সবাই তাকে 'অহিংসক' নামে ডাকত। পূর্বজন্মের সুকর্মের ফলে তার দেহে সপ্ত হস্তীর বল ছিল ।
চরিতমালা
অহিংসককে বিদ্যাশিক্ষার জন্য তক্ষশীলায় পাঠানো হলো। সে পাঠে অত্যন্ত মনোযোগী হয়ে ওঠে। সে সময়ের রীতি অনুসারে আচার্যের সেবায়ও সে খুব দায়িত্বশীল ছিল। সে আচার্য ও তাঁর পত্নীকে যত্ন সহকারে সেবা করত। অল্প সময়ের মধ্যে সে সকল শাস্ত্রে কৃতিত্বের পরিচয় দিল । সমগ্র বিদ্যালয়ে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ল । ব্রাহ্মণপত্নীও তাকে খুব আদর-যত্ন করতেন। কিন্তু অন্যান্য ছাত্রদের তা সহ্য হতো না। তারা ষড়যন্ত্র করে এবং মিথ্যা অপবাদ রটিয়ে আচার্যের কান ভারী করে তুলল আচার্য ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে চরম শাস্তি প্রদানে উদ্যত হলেন ।
আচার্য ভাবলেন, অহিংসক খুব শক্তিশালী ও মেধাবী। তাকে কৌশলে মেরে ফেলতে হবে। একদিন ছুটি হলে কুমার অহিংসক নগরে যাচ্ছিল। এ সময় আচার্য তাকে ডেকে বললেন, দেখ, তোমার বিদ্যাশিক্ষা শেষ হয়েছে। আমাকে গুরুদক্ষিণা দিয়ে তোমার এখন নিজগৃহে যাওয়া উচিত। অহিংসক বলল, 'আচার্য। উত্তম কথা আপনাকে কিরূপ দক্ষিণা দেব? আচার্য বললেন, 'আমাকে দক্ষিণাস্বরূপ মানুষের ডান হাতের এক হাজার বৃদ্ধাঙ্গুলি দিতে হবে। আচার্য ভেবেছিলেন নরহত্যা করলে লোকে তাকে মেরে ফেলবে।
অহিংসক গুরুর আদেশ শিরোধার্য করে নিল। গুরুর ইচ্ছা পূরণে সে তৎপর হলো। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে জালিনী বনে বাসস্থান তৈরি করল অহিংসক। বনটি ছিল আটটি রাজ্যের চলাচলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান। বহুলোক এই পথ দিয়ে আসা-যাওয়া করত। এ বনে অবস্থান করে সে গুরুকে দক্ষিণা দেয়ার জন্য নরহত্যা শুরু করল। অহিংসক একেকটি নরহত্যা করে বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে মালা আকারে গেঁথে গলায় ধারণ করত। সেজন্য সে অঙ্গুলিমাল নামে পরিচিতি লাভ করে। এ সংবাদ ক্রমে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। অঙ্গুলিমালের নৃশংসতায় কোশল রাজ্যের জনগণ ভীত-সন্ত্রস্ত হলো । সকলের মনে দারুণ উৎকণ্ঠা। সবাই মরণভয়ে ভীত। কোশলরাজ প্রসেনজিতের কাছে এ সংবাদ প্রেরণ করা হলো । তিনি নরঘাতক দস্যুকে ধরার জন্য কিছু সৈন্য প্রেরণ করলেন। পুত্রের প্রাণ রক্ষার জন্য পিতা কোনো চেষ্টাই করলেন না। কিন্তু মা মস্তানী ছেলের এ বিপদে অস্থির হলেন। শেষে পাগলিনীর মতো ছুটে চললেন জালিনী বনের দিকে। পথিকরা কত নিষেধ করল। সেদিকে তাঁর খেয়াল নেই । দস্যু হলেও নিজের পুত্র। তার জীবন রক্ষা করতেই হবে।
সে সময় ভগবান বুদ্ধ জেতবনে অবস্থান করছিলেন। তিনি দিব্যজ্ঞানে অবগত হলেন যে, অঙ্গুলিমাল পূর্বজন্মের বহু সুকৃতির অধিকারী। এই মুহূর্তে ধর্মবাণী শ্রবণ করলেই তার জ্ঞানচক্ষু উৎপন্ন হবে । তখন বুদ্ধ অঙ্গুলিমালের পাশবিক শক্তিকে দমন করার জন্য মনস্থির করলেন। মাতৃহত্যা মহাপাপ । এ মুহূর্তে মাতৃহত্যা তার পূর্বজন্মের সুফলকে স্নান করে দেবে। তার জ্ঞানচক্ষু লাভ চিরতরে রুদ্ধ হবে। সে আজ নিজ মাতাকে হত্যা করে গুরুদক্ষিণা দেবে। বুদ্ধ সে নারীর প্রাণরক্ষার্থে এবং অঙ্গুলিমালকে মাতৃহত্যাজনিত পাপ হতে রক্ষা করার জন্য ঘটনাস্থলে যাত্রা করলেন। সে দিনটি ছিল অঙ্গুলিমালের নরহত্যার শেষ দিন। সে নয়শ' নিরানব্বইটি মানুষের বৃদ্ধাঙ্গুলি সংগ্রহ করেছে। মাত্র আর একটি বাকি । একজন লোক হত্যা করতে পারলেই তার বাসনা পূর্ণ হবে। অঙ্গুলিমাল তার মাতাকে দূর থেকে আসতে দেখল। তখন অঙ্গুলিমালের মনে মাতা- পুত্রের সম্পর্কের লেশমাত্র প্রভাব নেই । অঙ্গুলি সংগ্রহই তার প্রধান লক্ষ্য। সে খড়গ তুলে তার মায়ের দিকে ধাবিত হলো। ঠিক সে সময় সমস্ত বনভূমি আলোকিত করে বুদ্ধ অঙ্গুলিমালের সামনে আবির্ভূত হলেন। এ সময় অঙ্গুলিমাল চিন্তা করল এ বৃদ্ধ নারীকে হত্যার পূর্বে মুক্তি কেশ গৈরিক বসনধারী ভিক্ষুকে হত্যা করব । এরূপ ভেবে আবার বুদ্ধের দিকে ছুটতে লাগল। কী আশ্চর্য। ক্রমাগত ছয় কোশ পথ অতিক্রম করেও সে বুদ্ধকে ধরতে পারছিল না। সে ক্লান্ত হয়ে ভাবল আমার দ্রুতগামী অশ্বকে ধরতে বিলম্ব হয় না। কিন্তু আমি একজন শ্রমণকে ধরতে পারছি না। আশ্চর্য ব্যাপার। এরূপ চিন্তা করে অঙ্গুলিমাল বিকট চিৎকার করে বলল, দাঁড়াও ভ্রমণ। ভগবান বললেন, 'অঙ্গুলিমাল, আমি স্থির আছি, তুমি স্থির হও। বুদ্ধের একথা শুনে সে চিন্তা করল, ভ্রমণগণ সত্যবাদী, অথচ স্থির হওয়ার জন্য আমাকে বলছেন। তার কারণ কী? সে আর এক পাও অগ্রসর হতে পারল না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে রইল। ভার সব চেষ্টা ব্যর্থ হলো। বুদ্ধ বললেন, 'আমি সর্বদা প্রাণীদের প্রতি দণ্ড-দান থেকে বিরত থাকি। তাই স্থির ভূমি প্রতিনিয়ত প্রাণিহত্যায় রত আছ। তাই অস্থির। তা শুনে অজুলিমালের পাষাণ হৃদয় করুণারসে সিক্ত হলো। অস্ত্র ভূমিতে নিক্ষেপ করল। বুদ্ধকে বন্দনা করে প্রব্রজ্যা প্রার্থনা করল। বৃদ্ধ 'এসো ভিক্ষু' বলার সঙ্গে সঙ্গে ঋদ্ধিময় পাত্র চীবর লাভ করে উপসম্পদা প্রাপ্ত হলেন। পরে খ্যানে মগ্ন হয়ে অর্থত্ব ফলে প্রতিষ্ঠিত হন। অর্থত্ব লাভ করে তিনি বিমুক্তি সুখে অনেক আনন্দগাথা উচ্চারণ করেছিলেন। নিচে তাঁর ভাষিত পাখাগুলোর সারমর্ম দেয়া হলো।চরিতমালা
'আমার কারণে যারা জ্ঞাতি বিয়োগ দুঃখ ভোগ করেছেন তারা আমার ধর্মকথা শ্রবণ করুন। আমার বাক্য শুনে সকলে বুদ্ধ শাসনে সৎকার্য সম্পাদনে নিযুক্ত হোন। ধার্মিক কল্যাণ মিত্রের সেবা করুন। যাঁরা ক্ষান্তিশীলতার কথা বলেন, মৈত্রী ধর্মের প্রশংসা করেন তাঁদের নিকট ধর্ম শ্রবণ এবং যথাধর্ম আচরণ করুন। কাউকেও হিংসা করবেন না। নির্বাণ প্রাপ্ত হয়ে সকল প্রাণীকে নিজের সন্তানের মতো প্রতিপালন করবেন। হস্তীকে অঙ্কুশ দ্বারা, অশ্বকে কশাঘাত দ্বারা দমন করে। পণ্ডিতগণ নিজেকে অর্হত্ব ফলের দ্বারা দমন করেন। আমি বুদ্ধ কর্তৃক বিনা দণ্ডে দমিত হয়েছি। পূর্বে আমার নাম হিংসক হলেও আমি অহিংসক নামে পরিচিত ছিলাম। আজই আমার অহিংসক নাম সত্যে পরিণত হয়েছে। আমি আর কাউকে হিংসা করি না।'
অনুশীলনমূলক কাজ
অঙ্গুলিমালের জন্মের সময় কী হয়েছিল লেখ। আচার্য গুরুদক্ষিণা স্বরূপ অঙ্গুলিমালের নিকট কী চাইলেন?
পাঠ : ৩ মহাপ্রজাপতি গৌতমী
মহাপ্রজাপতি সুপ্রবুদ্ধের পরিবারে দেবদহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রানি মহামায়ার কনিষ্ঠ বোন ছিলেন। রাজা শুদ্ধোদন দুই বোনকেই বিয়ে করেন। জ্যোতিষীগণ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকের সন্তান রাজচক্রবর্তী রাজা হবেন। সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্মের সপ্তাহকাল পরে তাঁর মাতা রানি মহামায়ার মৃত্যু হয়। মহাপ্রজাপতি গৌতমীই সিদ্ধার্থের লালন পালনের ভার গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন নন্দের মাতা। কথিত আছে, তিনি নিজ পুত্রের দেখাশোনার ভার ধাত্রীর ওপর অর্পণ করে নিজে সিদ্ধার্থ গৌতমকে প্রতিপালন করতেন। গৌতম সিদ্ধার্থের গোত্রের নাম । গৌতমের লালন-পালনকালী হিসেবে তিনি মহাপ্রজাপতি গৌতমী নামে পরিচিতি লাভ করেন ।
পরিণত বয়সে রাজা শুদ্ধোদনের মৃত্যু হয়। এতে রাজ্য ও সংসারের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে ওঠেন মহাপ্রজাপতি গৌতমী । এসময় তিনি সন্ন্যাস জীবন লাভে আগ্রহী হলেন। এজন্য কীভাবে কী করা যায় তিনি চিন্তা করতে লাগলেন।
সেসময় শাক্য ও কোলিয়দের মধ্যে রোহিনী নদীর জল নিয়ে বিবাদ হয়েছিল। বুদ্ধ সে বিবাদ মীমাংসার জন্য বৈশালী থেকে কপিলাবস্তু যান। এতে মহাপ্রজাপতি গৌতমীর আকাঙ্ক্ষিত সুযোগ উপস্থিত হয়। বিবাদ মীমাংসা হলে বুদ্ধ তাদেরকে কলহবিবাদ সূত্র দেশনা করেন। এসময় পাঁচশত শাক্যকুমার ভিক্ষুসঙ্ঘে যোগদান করেন। তাঁদের স্ত্রীগণ মহাপ্রজাপতি গৌতমীর নেতৃত্বে বুদ্ধের নিকট উপস্থিত হয়ে ভিক্ষুণীব্রত গ্রহণ করার অনুমতি প্রার্থনা করেন। কিন্তু বুদ্ধ তাঁদের অনুরোধ বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা
প্রত্যাখ্যান করে বৈশালীতে চলে যান। মহাপ্রজাপতি ও তাঁর সহচারিণীগণ হতাশ না হয়ে কেশ কর্তন এবং কাষায়বস্ত্র পরিধান করে বৈশালী পর্যন্ত বুদ্ধের অনুগমন করেন। তাঁরা ক্ষতবিক্ষত পায়ে বিহারে উপস্থিত হয়ে দ্বিতীয়বার বুদ্ধকে অনুরোধ জানান। শেষে আনন্দ থের তাদের ভিক্ষুণীধর্মে দীক্ষা দেয়ার জন্য বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা জানান। অবশেষে বুদ্ধ প্রার্থনা অনুমোদন করলে মহাপ্রজাপতি গৌতমীর বাসনা পূর্ণ হয় । নারীগণ সঙ্ঘভুক্ত হওয়ার সুযোগ পেলেন। তিনি প্রব্রজ্যা লাভ করলেন ।
দীক্ষার পর তিনি বুদ্ধের কাছে উপস্থিত হয়ে বন্দনা করেন। বুদ্ধ তাঁকে ধর্মোপদেশ দান করেন। তিনি ধর্মোপদেশ অনুসরণ করে অর্হত্ব ফল লাভ করেন। তার পাঁচশত সহচারিণী জেতবনে বৃদ্ধের নিকট নন্দকোবাদ সূত্র শ্রবণ করে অর্হত্ব ফল লাভ করেন। বুদ্ধ মহাপ্রজাপতি গৌতমীকে জ্ঞানে থেরীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করেন। বৈশালীতে অবস্থানকালে মহাপ্রজাপতি গৌতমী নির্বাণ লাভ করেন।
তিনি বুদ্ধের অনুমতি গ্রহণ করে নানাবিধ ঋন্ধি প্রদর্শনের পর দেহত্যাগ করেন। কথিত আছে, বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের সময় যেসব অদ্ভুত ব্যাপার সংঘটিত হয়েছিল সেরূপ মহাপ্রজাপতি গৌতমীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়ও সংঘটিত হয়েছিল। যেমন সকলের প্রার্থনা শেষে তাঁর শ্মশান স্বয়ং অগ্নি প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে। মহাপ্রজাপতি অর্হত্ব প্রাপ্তির পর মনের সুখে অনেক প্রীতিগাথা উচ্চারণ করেছিলেন। নিচে তাঁর ভাষিত কয়েকটি গাথার বাংলা অনুবাদ দেয়া হলো :
১. সর্বশ্রেষ্ঠ সত্ত্বা বুদ্ধবীরকে নমস্কার করছি। তিনি আমার এবং অন্যান্য বহুজনের দুঃখমোচন করেছিলেন।
২. সর্বদুঃখের কারণ আমার জ্ঞাত হয়েছে। অশুভর হেতু তৃষ্ণা আমার এখন বিশুদ্ধ হয়েছে। আমি দুঃখের নিবৃত্তির কারণ আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গে বিচরণ করেছি।
৩. পূর্বে আমার জ্ঞান অপরিপক্ক ছিল। তাই আমি লক্ষ্যহীনভাবে মাতা, পিতা, পুত্র, ভ্রাতা, মাতামহীরূপে কতবার জন্মেছি।
৪. সর্বদা শ্রাবক সঙ্ঘের গুণাবলির দিকে লক্ষ রাখবে। তাঁরা দৃঢ় পরাক্রমশালী, উদ্যমশালী,
ধ্যানপরায়ণ ও বীর্যবান । তাঁরা সঙ্ঘবদ্ধভাবে বিচরণশীল। তাঁদের পথ অনুসরণ করবে।
৫. কী আশ্চর্য! বহুজনের হিতার্থে মহামায়া সিদ্ধার্থকে প্রসব করেছিলেন । সত্যিই তিনি কত গুণের আধার। সেই পৌতম জরা, ব্যাধি, মৃত্যুর হাত থেকে প্রাণীগণকে রক্ষা করছেন। সকল দুঃখের বিনাশসাধন করেছেন।
অনুশীলনমূলক কাজ
'মহাপ্রজাপতি গৌতমী' কীভাবে নামকরণ হয় লেখ ।
নারীদের সঙ্ঘভুক্ত করার জন্য কে বুদ্ধের নিকট প্রার্থনা করেছিলেন?
৮৮
বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা
দানকার্য শেষে মল্লিকাদেবী নিজ শোকার্ত পুত্রবধূদের ডেকে বললেন, 'তোমরা নিরাপরাধ। তোমাদের স্বামীগণ পূর্বকর্মের ফল ভোগ করেছে। শোক করো না । রাজার প্রতিও বিদ্বেষভাব পোষণ করো না। রাজা এ সংবাদ চরের মুখে শুনে মল্লিকার নিকট এসে ক্ষমা চাইলেন। পুত্রবধূরা স্ব স্ব পিত্রালয়ে চলে গেল। মল্লিকাদেবীও আপন পিত্রালয়ে আজীবন ত্রিরত্নের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। বুদ্ধ পরিনির্বাপিত হলে তার সপ্তরত্নখচিত 'মহালতা প্রসাধন' দান করে ধাতুচৈত্য নির্মাণ করেন তিনি যথাকালে দেহত্যাগ করে দেবলোকে উৎপন্ন হয়েছিলেন। তাঁর ধৈর্য, সহনশীলতা এবং ক্ষমাশীলতা অনুকরণীয়।
অনুশীলনমূলক কাজ
মল্লিকাদেবী কার স্ত্রী ছিলেন? মল্লিকাদেবী শোকার্ত পুত্রবধূদের কী উপদেশ দিয়েছিলেন?
পাঠ : ৫
বুদ্ধঘোষ
বুদ্ধঘোষ ছিলেন বিখ্যাত পালি অট্ঠকথা রচয়িতা। 'অকথা' শব্দের অর্থ অর্থকথা বা ভাষ্য। বুদ্ধঘোষ খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মস্থান নিয়ে মতভেদ রয়েছে। বুদ্ধঘোসুপ্পত্তি, চুল্লবংস প্রভৃতি গ্রন্থে তিনি বুদ্ধগয়ার নিকটবর্তী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু বর্তমানকালের পণ্ডিতগণ মনে করেন, তিনি দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন পণ্ডিত ব্রাহ্মণ। তিনি খুবই মেধাবী ছিলেন। অল্প বয়সেই তিনি ত্রিবেদে পারদর্শীতা অর্জন করেন। তিনি বিতর্ক করে সমগ্র ভারতবর্ষ পরিভ্রমণ করে বেড়াতেন । তাঁর তীক্ষ্ণ মেধা ও যুক্তির কাছে সকলেই পরাজিত হতেন। এমনি করে বিতর্ক করে বেড়ানোর সময় তিনি এক বিহারে এসে উপস্থিত হন। সেই বিহারে তিনি রেবত থের'র নিকট অভিধর্মের ব্যাখ্যা শুনে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন। তাঁর কণ্ঠ বুদ্ধের মতো গম্ভীর, তাঁর দেশনা বুদ্ধের মতো হৃদয়গ্রাহী এবং মর্মস্পর্শী হওয়ায় দীক্ষার পর তিনি বুদ্ধঘোষ নামে খ্যাত হন ।
বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই তিনি ত্রিপিটকে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। অতঃপর, তিনি ঞানোদয় (জ্ঞানোদয়) এবং ধর্মসঙ্গনীর অকথা অথসালিনী রচনা করেন । তারপর তিনি পরিত্তটঠকথা গ্রন্থটি রচনা আরম্ভ করেন। গুরু তাঁর পাণ্ডিত্য দেখে মুগ্ধ হন। সে সময় ভারতে অঠকথা ছিল না বলে শুরু তাঁকে সিংহলে গিয়ে সিংহলি ভাষায় সংরক্ষিত অটঠকথাসমূহ পালি ভাষায় রচনা করার জন্য উপদেশ প্রদান করেন। গুরুর নির্দেশে তিনি সিংহলের অনুরাধাপুরার মহাবিহারে গমন করেন। তখন সিংহলের রাজা ছিলেন চরিতমালা
মহানাম। সেখানে তিনি মহাবিহারের সঙ্ঘপ্রধান সঙ্ঘপাল থের'র নিকট থেরবাদ ও অকথা অধ্যয়ন করেন। শিক্ষাগ্রহণের পর তিনি পালি ভাষায় অটঠকথা রচনার উদ্দেশ্যে মহাবিহারে সংরক্ষিত গ্রন্থসমূহ প্রদানের জন্য সঙ্ঘপাল থেরকে অনুরোধ করেন । তখন মহাবিহারের ভিক্ষুসঙ্ঘ তাঁকে দুটি গাথা প্রদান করেন এবং গাথাদ্বয় ত্রিপিটকের সাহায্যে ব্যাখ্যা করে তাঁর যোগ্যতা প্রদর্শনের জন্য আদেশ করেন। পাথাদ্বয়ের ব্যাখ্যাস্বরূপ তিনি বিখ্যাত বিসুদ্ধিমপ বা বিশুদ্ধিমার্গ গ্রন্থটি রচনা করেন। গ্রন্থটিকে ত্রিপিটকের সারসংকলন বলা হয়। এ গ্রন্থটি রচনা করে তিনি প্রভূত যশ খ্যাতি অর্জন করেন। কথিত আছে যে, দেবতারা তাঁর যশ খ্যাতি প্রচারের জন্য গ্রন্থটি লুকিয়ে রাখেন। তখন তিনি পুনরায় আর একটি গ্রন্থ রচনা করেন। দ্বিতীয়বারও দেবতারা গ্রন্থটি লুকিয়ে রাখেন। তিনি পুনরায় গ্রন্থটি রচনা করে যখন সংঘের নিকট সমর্পণ করতে যাচ্ছিলেন তখন দেবতাগণ অপর দুটি গ্রন্থও যথাস্থানে রেখে যান। ভিক্ষুগণ তিনটি গ্রন্থ পাঠ করতে আরম্ভ করেন এবং দেখেন যে তিনটি গ্রন্থই হুবহু এক। তখন মহাবিহারের ভিক্ষুগণ সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে মৈত্রেয় বোধিসত্ত্ব' উপাধিতে ভূষিত করেন।
সিংহলের ভিক্ষুসঙ্ঘ তাঁর পাণ্ডিত্য ও লেখার দক্ষতা দেখে 'অটঠকথা' অনুবাদ করার অনুমতি দেন। অতঃপর তিনি অনুরাধপুরার মহাবিহারের গ্রন্থাগারে প্রবেশ করে অটঠকথা রচনা করতে থাকেন। তিনি ষোলটি গ্রন্থ রচনা করেন বলে জানা যায়। গ্রন্থগুলো হলো :
১। ঞাণোদয় (জ্ঞানোদয়) ২। অথসালিনী ৩। পরিতঠকথা ৪। বিসুদ্ধিমগ্গ ( বিশুদ্ধিমার্গ)
৫। সমস্তপাসাদিকা ৬। কঙ্কাবিতরণী ৭। সুমঙ্গলবিলাসিনী ৮। পপঞ্চসূদনী ৯। সারথপকাসিনী ১০। মনোরথপূরণী ১১। সম্মোহবিনোদনী ১২। পঞ্চপকরণটঠকথা ১৩। পরমথজোতিকা ১৪। ধম্মপদঠকথা ১৫। জাতককথা এবং ১৬। বিসুদ্ধজনবিলাসিনী ।
দীর্ঘ পরিশ্রমের পর বুদ্ধঘোষ সিংহলি অটঠকথা পালি ভাষায় অনুবাদ করে ভারতে ফিরে আসেন। এভাবে মহাপন্ডিত বুদ্ধঘোষ অঠকথা রচনা করে বৌদ্ধ সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন, বৌদ্ধধর্ম দর্শনকেও সহজতর করে তুলেছেন। কালজয়ী গ্রন্থ রচনা করে বৌদ্ধ সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে আছেন।
অনুশীলনমূলক কাজ
অটঠকথা শব্দের অর্থ কী?
বুদ্ধঘোষ নামের বিশেষত্ব বর্ণনা করো।
বুদ্ধঘোষ রচিত গ্রন্থগুলোর একটি তালিকা তৈরি করো।
ফর্মা-১২, বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা-অষ্টম শ্রেণি
Read more